বৈশাখকে জনমানুষের হতে না দেওয়ার
জন্য প্রথম অপরাধী হলো আওয়ামী বুদ্ধিজীবিরা। তারা চেয়েছে বৈশাখ দিয়ে রাজনীতি করতে,
সমাজে বিভেদ তৈরি করতে। তারা সেটাতে সফলও হয়েছে। ব্রিটিশ সময়ে যেমন হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা
লাগিয়ে ক্ষমতার মসনদ পাকা রাখা হতো ঠিক একই কায়দায় আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলে
সংস্কৃতিকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। অথচ সংস্কৃতি বহমান নদীর মত। শত বছর, হাজার বছর ধরে
এটি বয়ে চলে। আমি, আমরা খুব সহজে হয়তো হারিয়ে যাই কিন্তু সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে টিকে
থাকে। এটি আমাদের অস্তিত্ব। আমার অনুপস্থিতির পরও আমার এক ধরনের উপস্থিতি বিদ্যমান।
এই সংস্কৃতিতে আমরা অনুভব করতে পারি আমাদের পূর্বপুরুষদের, অনুভব করতে পারি জীবনকে,
অনুভব করতে পারি আমাদের চারপাশের মানুষকে।
অনেকে তুলনা করেন কিংবা মুখোমুখি
দাঁড় করিয়ে দেন সংস্কৃতি না ধর্ম। আসলে এভাবে না ভাবলেই বোধহয় আমাদের জন্য মঙ্গলকর।
ধর্ম স্রষ্টার সাথে তাঁর সৃষ্টির সম্পর্ক। আর সংস্কৃতি আমাদের নিত্য জীবনের বেড়ে উঠা
গল্প। এখানে ধর্মও থাকতে পারে কোনো বাধা নেই। জীবনে অনেক পরত থাকে। অনুভব করে করে সেটা
উপলব্ধি করতে হয়। কেউ হয়তো ধর্ম দিয়ে উপলব্ধি করে কেউ হয়তো সংস্কৃতি দিয়ে উপলব্ধি করে
কেউ বা দুটো মিলে মিশে একাকার। তবে স্রষ্টাকে জানতে চাওয়া, তাঁর সৃষ্টিকে জানতে চাওয়া
এই কৌতুহল মানুষের চিরন্তন। এই কৌতুহল থেকেই হয়তো ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রচলন বহমান
নদীর মত বয়ে চলেছে।
ধূর্ত মানুষেরা তাদের স্বার্থে
ধর্ম আর সংস্কৃতিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যেমন ধূর্ত লোকেরা তার ধর্ম সেরা বলে
পৃথিবী শাসন করতে চেয়েছে তেমনি ধূর্ত লোকেরা তার সংস্কৃতি সেরা বলে পৃথিবী শাসন করতে
চেয়েছে। আর এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে রাজনীতি-ক্ষমতার মোহ, লোভ, লালসা, শাসন এবং শোষন করার
আদিম বাসনা।
সেই আদিকাল থেকেই প্রত্যেকটা
জাতির ধর্ম এবং সংস্কৃতি আমরা দেখতে পাই এবং সেটা উত্তর আধুনিক কাল পর্যন্তও বিস্তৃত।
যেমন আরবদের সংস্কৃতি- তাদের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার ইত্যাদি থেকে ইউরোপিয়ানদের
সংস্কৃতি- তাদের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার সম্পূর্ন আলাদা। তাদের ধর্মও আলাদা।
আবার আরবদের ধর্ম আর বাঙালী মুসলিমদের ধর্ম এক হলেও সকল ধর্মীয় রীতি নীতি এক নয়, সংস্কৃতিতো
একেবারেই আলাদা। আমরা আরবদের কাছ থেকে ধর্ম নিয়েছি কিন্তু পুরোপুরি সংস্কৃতি নেয়নি।
আবার আমরা পশ্চিমের কিছু সংস্কৃতি নিয়েছি কিন্তু তাদের ধর্ম নেয়নি। বিদায় হজ্জের পর
থেকেইতো আমাদের এখানে ইসলামের আবির্ভাব এবং তারও অনেক পরে অন্য অনেক সংস্কৃতি আমাদের
এখনো যুক্ত হয়েছে। এটা ভালো বা খারাপ সেই অর্থে আপাতত যাচ্ছিনা। কিন্তু ইসলাম আসার
আগেও আরবে তাদের যেমন কিছু সংস্কৃতি ছিল তেমনি আমাদের এই জনপদে সংস্কৃতি এবং ধর্ম দুটোই
ছিল। মানুষ ধর্ম সহজে বদলাতে পারলেও সংস্কৃতি সহজে বদলাতে পারেনা। বদলের প্রয়োজন হয়তো
পড়েনা। এটা মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকে। একটা কথা আছে- কোনো জাতিকে
ধ্বংস করতে চাইলে প্রথমে তার সংস্কৃতি ধ্বংস করে দাও তাহলে সে অর্ধেক শেষ। জাতি হিসেবে
আমরা এখনো সংস্কৃতির মূল্যমান বুঝতে শিখছিনা। ধর্ম আর সংস্কৃতিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে
দিয়ে ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠছি।
আরবের লোকে রুটি খায় আমাদের গ্রামের
মানুষ পান্তাভাত খেতে আনন্দ পায়। তিন বেলা ভাত খাওয়ার যে সংস্কৃতি আমাদের এখানে গড়ে
উঠেছে তারতো কিছু কারন আছে। কৃষক ফসল ফলায়, ফসল বিক্রি করে, উদ্ধৃত চাল থেকে যায় সেই
চাল দিয়ে সে তার ক্ষুধা মেটাই। অনেকেই হয়তো সকালে তরকারি যোগাড় করতে পারতোনা হয়তো লবন
দিয়ে সাথে কাচা মরিচ সহ পান্তা ভাত খেয়ে ক্ষেতে কাজ করতে যেত। এখন সেই সংস্কৃতিকে স্মরন
করে শহুরে লোকেরা যারা সারা বছর ঘিয়ে ভাজা পরোটা কিংবা আধুনিক স্যান্ডউইচ, বার্গার
খেয়ে জীবন ধারন করে সে নববর্ষের দিনে শখ করে পান্তা ভাত খেতে চাইছে। তাতে ক্ষতি কি!
হয়তো কখনো সে উপলব্ধি করবে জীবন সহজ নয়।
ফিরে আসি এবারের বৈশাখ নিয়ে।
স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে কিন্তু আমাদের মনের ভেতরে যে স্বৈরবৃত্তি বাস করে তা কি আমরা
দূর করতে পারছি? এবার একটা খুব বড় সম্ভাবনা ছিল বৈশাখকে গণমানুষের কাছে ফিরিয়ে আনার,
সার্বজনীন করার। কিন্তু সেটা হতে পারলো কই?
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সব নষ্টের
মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ তারা অভিভাবকসুলভ সুন্দর ভূমিকা রেখে জাতিকে সুসংগঠিত, ঐকবদ্ধ
করতে পারতো। কিন্তু অযোগ্য নের্তৃত্যের কারনে জুলাই অভ্যুত্থানের সুফল আমরা এই বৈশাখে
পেলামনা। এই দায়ভার কে নেবে? এই ক্ষতিইবা আমরা কিভাবে পূরণ করবো?
পতিত স্বৈরাচার হাসছে, তার দোসররা
হাসছে তারা ঠিকই আগের মত জাতিকে বিভক্ত করে রাখতে পেরেছে। এতে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা
আছে।
চারুকলা বহু আগেই মরে গেছে এখন
শুধু পচে পচা লাশের গন্ধ ছড়াচ্ছে। সংস্কৃতিকে আর হয়তো চারুকলা প্রতিনিধিত্ব করেনা।
শিল্পী এবং তার চেয়ে বেশী রাজনীতিবিদ নিসার হোসেন গংরা বহু আগেই একে গলা টিপে মেরে
ফেলেছেন। জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশে প্রাণ সঞ্চার করলেও চারুকলায় পারেনি। আসলে পারবে
কি করে! চারুকলাতো মৃত লাশ।
এখন সময় নতুন চারা রোপনের। তার
আগে প্রয়োজন মাটি প্রস্তুতের। তারপর হয়তো বীজ থেকে কোনো এক ভোরে চারা গজাবে। আসুন সবাই
মিলে বাংলাদেশের মাটি প্রস্তুত করি ভবিষ্যতের বসবাসের উপযোগি করার জন্য।
নতুন প্রজন্ম জুলাই অভ্যুত্থান
এর মত আমাদের হয়তো পথ দেখাবে। অন্তত তাদের উপর আমরা আস্থা রাখতে পারি। ভুল হলে বড়রা
না হয় তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ভুল শুধরে দেবে।
শুভ নববর্ষ
১৪৩২
ফরহাদ উদ্দিন মাসুম
১৪ এপ্রিল ২০২৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন