চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা ও মুখোশ
০১.০১.১৪৩০
১৪.৪.২০২৩
চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা খুব বেশীদিনের নয়, অনেকেই বলেন হাজার বছরের সংস্কৃতি। আদতে মোটেও এটি হাজার বছরের সংস্কৃতি নয়। খোদ চারুকলা প্রতিষ্ঠানেরই বয়স বেশিদিনের নয়। এখনো ১০০ বছর হয়নি। তবুও এটি ঢাকা শহর তথা বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। আমাদের বৈশাখ উদযাপন অনেক পুরনো। সেটি হয়তো হাজার বছরের সংস্কুতি। সেখানে হয়তো মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিলনা কিন্তু বৈশাখ উদযাপন তথা নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার অনেক উপকরন ছিল যেমন: হালখাতা, বৈশাখী মেলা, নাগর দোলা, মুরালী, টেপা পুতুল, হাত পাখা, মাটির জিনিসপত্র, শখের হাঁড়ি ইত্যাদি।
হঠাৎ কোথা থেকে যেন উদয় হল বৈশাখী র্যালি তথা মঙ্গল শোভাযাত্রা। সারা ঢাকা বাসী আপন করে নিল এই বৈশাখী র্যালি তথা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে। ধীরে ধীরে এটি সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়লো এবং আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলো। যার শুরুটা হয়েছিল চারুকলা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এবং এখনো এর নেতৃত্বে চারুকলা প্রতিষ্ঠানই থাকে। কিন্তু কিসের বোধ থেকে এই বৈশাখী র্যালি তথা মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু……….
স্বৈরাচার প্রতিরোধে ঘৃনার এক প্রতিফলন ছিল এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। বর্ষবরনের পাশাপাশি যা ছিল শিল্পী/সচেতন মানুষের রাজনীতির বহি:প্রকাশ।
সংস্কৃতি আর রাজনীতি কি সম্পূর্ণ আলাদা? কিন্তু কখনো কখনোতো এক হয়ে উঠে যেমন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, বায়ান্ন। সংস্কৃতি কর্মীরাইতো এখানে তাদের রাজনীতির বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
এখন পাঠক বলতেই পারেন বৈশাখতো হাজার বছরের বাঙালীর সংস্কৃতি এখানে রাজনীতির কি আছে? আসলে মানুষ কোনো না কোনো ভাবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। সে কোনো রাষ্ট্রে বাস করা মানেই সে রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত।
এখন বৈশাখ যেহেতু বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব এটার মর্যাদাই আলাদা। এটির প্রস্তুতি আলাদা। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই বৈশাখ উদযাপন করে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় তাই নানা রকমের জিনিসপত্র তৈরি হয় যেমন: মুখোশ, প্যাচা, বাঘ, হাতি, ঘোড়া, টেপা পুতুল ইত্যাদি। যা আসলে আমাদের সংস্কৃতিরই উপাদান। প্রতিটি জিনিস শুধু আমাদের আনন্দ দেয়না আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। বৈশাখ উদযাপনে পান্তাভাত আর ইলিশ কেন উঠে এসেছিল কারন এটিও আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। ইউরোপ, আমেরিকা, আরব, আফ্রিকা ওখানে পান্তাভাত ইলিশ পাওয়া যাবেনা কারন ওটা ওদের সংস্কৃতি না। কালের বিবর্তনে ইলিশ আমাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ছিল বটে। যা আমরা এখনো বয়ে চলি।
এখন এই যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি সাধারনের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে যার দরুন একজন দিনমজুর বলছেন “মাছ, মাংস ও চালের স্বাধীনতা চাই” – এটি হতে পারতো এবারের মঙ্গলশোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তাহলে বৈশাখ সাধারন মানুষকেই তুলে ধরতো। সাধারন মানুষের সাথে মঙ্গলশোভাযাত্রার যোগাযোগ তৈরি হতো। সংস্কৃতি যদি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তবে তা মানুষের কাজে লাগেনা একসময় তা মৃত হয়ে পড়ে।
উপরন্তু শিল্পীরা সংবাদ মাধ্যমের মত প্রকাশের উপর সেন্সরশিপ আরোপ করতে চাই। এমনকি পত্রিকা বন্ধ করার জন্য তারা স্বাক্ষর দিয়েছেন। তারা শিল্পকর্মের উপরও সেন্সরশিপ আরোপের পক্ষে। সুতরাং মৌলবাদ এবং প্রগতিশীল নামধারী এইসব ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠানের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। আমাদের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যারা সংস্কৃতি রক্ষাকারি বলে নিজেদের মনে করে তারা আসলে সংস্কৃতি ধ্বংসকারী। শিল্পী নিসার স্যার এন্ড গংরা চাইনা চারুকলার বৈশাখ সার্বজনীন হোক। এতে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয়। তারা বিএনপি আমলে সুশীল সাজে। আওয়ামী আমলে সরকারের আজ্ঞাবহ থাকে। কারন তারা যতটা না শিল্পী তার চেয়ে বেশী রাজনীতিবিদ।
হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ বহু পুরনো বিট্রিশরা যার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল যাতে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয়। বোকা হিন্দু মুসলিম এই ফাঁদে পা দিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় চারুকলার মুখোশের মত প্রগতিশীল নামধারী, সংস্কৃতির ঝান্ডাধারী কিছু মানুষ, কিছু রাজনীতিবিদ সেই পুরনো রাজনীতিকে এখনো বয়ে চলেছেন। এতে তাদের রাজনীতিতে সুবিধা হয়। তাদের ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত হয়।
যা আসলে এই জনপদের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। বৈশাখ নিয়ে এই রাজনীতি আমাদের জাতীয় জীবনে কখনো সুফল বয়ে আনবেনা। বৈশাখ হতে পারতো বাঙালীর (এপার বাংলা ওপার বাংলা) সবচেয়ে বড় উৎসব (ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে)। কিন্তু এইসব মুখোশধারী কিছু ব্যক্তি কখনো এটা হতে দিতে চাইনা। এ যেন সর্ষের ভিতর ভূত।
তাই হয়তো মঙ্গলশোভাযাত্রায় মুখোশ আমাদেরকেই তুলে ধরে।
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা….