হাজার বছর বাঙ্গালির ইতিহাস। রাজতন্ত্রের
ভয়াল সময় পেরিয়ে আজ বাঙালি অন্য এক সময়ে এসে পড়েছে। বিদেশি শাসক- মোঘল, ব্রিটিশ উপনিবেশ,
পাকিস্থান শাসন তারপর মুক্তির সংগ্রাম। তারপর যুদ্ধাত্তর পরবর্তী অস্থিরতা , সেনা ক্যু,
স্বৈরাচার শাসন, গণতন্ত্র নামক রসিকতা, ভোটের রাজনীতি কিছুই বাঙ্গালির রক্ত ত্যাগ ছাড়া
হয়নি। বাঙ্গালির জন্মই হয়েছে যেন প্রতিবাদ করার জন্য আর গুলি খেয়ে মরার জন্য। প্রতিটি
সময়ে বাংলায় জন্ম হয়েছে কিছু সাহসী সূর্য পুরুষের- সূর্য সেন, ৭ বীর শ্রেষ্ঠ, তাজ উদ্দিন,
কর্নেল তাহের, সিরাজ সিকদার, বীর বিক্রম, বীর প্রতীক, সেক্টর কমান্ডার, নজ্রুল, রবীন্দ্রনাথ,
জয়নুল, কাম্রুল, সুলতানসহ আরো অনেকে। কিছু বাতিক্রম অবশ্যই আছে- যারা শুধু মমতাময়ী মা নন, লালন করেছেন, পালন
করেছেন প্রান দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন অনেক
মানুষকে- প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমাম এই রকম আরো অনেক। কিছু বিশ্বাসঘাতক
বরাবরই বাঙ্গালিকে পিছিয়ে দিয়েছে। ইতিহাস যার নাম দিয়েছে মীর জাফর, রাজাকার, আলবদর,
আলশামস। তবুও বাঙালি সাহস করে বলেছে- ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মান চিত্র খাবো’। জয় বাংলা
যেন বাঙ্গালিকে সাহস জুগিয়েছে, প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে, ভুমি দিয়েছে, দেশ দিয়েছে। যে
দেশে শুধু বাঙালি নয় বাস করে অনেক ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা। চাকমা , মারমা, মুরং, গারো,
মনিপুরি, ত্রিপুরা, তন্চংগ্যা, রাখাইন ইত্যাদি। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতির
বৈচিত্র্য কি নেই বাংলাদেশে। প্রায় প্রতি ১২ কিলোমিটার পর পর ভাষার বৈচিত্র্য দেখতে
পাই আমরা। ইতিহাসের সাথে সাথে বাঙালি জনপথের নাম বদলে যায়। আমরা পায় প্রাণের বাংলাদেশ।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
বাঙালি প্রতিবাদ করে, প্রাণ দেয় আবার
ভুলে যায় কেন প্রতিবাদ করেছিল। বাঙ্গালির এমন রহস্যময় চরিত্র উপলব্ধি করেছেন হুমায়ন
আজাদ। যাকে ইতিহাসের সেই বিশ্বাস ঘাতক্ রা হত্যা করেছিল। যুগে যুগে তবুও জন্ম নেয় বাঙ্গালির
ঘরে এমন মানুষ- যারা মানুষের কথা হলে। বাঙালি এই নামটি যেন রক্ত দিয়ে লেখা। শোষণ, বঞ্চনা
ইত্যাদির পরও বাঙালি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু বাঙ্গালি মেয়েরা বড্ড ন্যাকা। তারা
যেন ঘর সংসার ছাড়া কিছুই বুঝেনা। একটুকরো ভাত কাপড় পেলে তাতেই খুশি হোকনা তাতে তরকারি
বাসি। তারপরও বাঙ্গালির ঘরে কেমন করে যেন কিছু সাহসী মেয়ের জন্ম হয়। আমাকে নতুন করে
ভাবতে শেখায়। আমাকে শেখায় তোমরা পুরুষরা যা পরোনা আমরা মেয়েরা তা পারি। সেটা শুধু সমতলে
নয় পিছিয়ে থাকা পাহাড়ি নারীটিও বেশ সাহসী। মা যেমন সন্তান কে পৃথিবী কি শেখায় তেমনি
নারী আমাকে শেখালো কিভাবে নিজের হিসেব বুঝে নিতে হয়। কিভাবে প্রতিবাদ করতে হয়। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনার পাঠ গুটালাম সেই অনেক বছর আগেই। যখন ছাত্রদল রাজত্ব করতো
তখন আমি প্রতিবাদ করতে শিখিনি। শুধু হুমায়ুন আজাদ স্যারের বিচার চেয়েছিলাম। তখনি বুঝেছিলাম
এই জল্লাদের দেশ আমারনা। যখন ছাত্র লীগের ছেলেরা আমাকে এসে বলে চাপাতি দিয়ে আমাকে টুকরো
টুকরো করে ফেলবে তখনও আমি প্রতিবাদ করতে শিখিনি। যখন ছাত্রলীগের ছেলেরা আমাকে আমার
প্রাণের জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই চারুকলা থেকে আমাকে বের করে দেয় তখনও আমি প্রতিবাদ
করতে শিখিনি। আমাকে প্রতিবাদ শেখালো কবি সুফিয়া কামাল হলের সেই সাহসী নারীরা। কবি
সুফিয়া কামাল নামটির কারনে কি তারা প্রতিবাদ কি জিনিস শিখে ফেলেছিল ? ইতিহাস কথা বলে।
যা পুরুষরা পারেনি তা নারী করে দেখালো। কবি নজ্রুল বলেছিলেন- ‘পৃথিবীর যা কিছু কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। কথাটার মানে বোধ হয় বুঝতাম না। মনের মধ্যে
সবসময় খটকা লাগতো আমাদের ৭ বীরশ্রেষ্ঠ সবাই পুরুষ। নারীর কি খুব সাহসী অবদান ছিলনা
!
আজকের সুফিয়া কামাল হলের মেয়েরা শুধু
একজন হল সভাপতিকে জুতার মালা পরায় নি তারা
যেন সেই হাজার বছরের পুরুষ তান্ত্রিকতার ভয়াবহ নির্যাতনকে রুখে দিয়েছে। যারা যুগ যুগ
ধরে এই বাংলাকে শোসিত করেছে, বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে বাংলার মানুষের সাথে। এই জুতার মালা
মীর জাফরের গলায় শোভা পেল। এশা সেখানে একটি নাম মাত্র। এই জুতার মালা বস্তুত শাসকের
গলায় শোভা পেল। যারা হাজার বছর বাঙ্গালির সাথে প্রবঞ্চনা করেছে। নারী তোমাকে সালাম।
জাগো নারী জাগো, তোমরাই আমাদের এগিয়ে নেবে।
শামসুল হক এর মত বলতে ইচ্ছে হয়- ‘জাগো
বাহে কোনটে সবাই’।
সকল নারী এবং পুরুষকে বাংলা নববর্ষের
শুভেচ্ছা। কোটি কোটি বছর বেঁচে থাকুক এই বাংলা জনপথ, এই বাংলাদেশ।
ফরহাদ
উদ্দিন মাসুম
১ বৈশাখ ১৪২৫